বিশ্বাস করেন আমিও প্রথমে ঘটনা শুনে হতবাক হয়েছিলাম। আমার আগের ব্লগপোস্টে আপনাদেরকে বলেছিলাম মুর্শিদাবাদের অলিতে গলিতে টাঙা গাড়িতে (ঘোড়ায় টানা বিশেষ বাহন) করে ঘুরেছি আমি। আমাকে এবং আমার টিমকে ঘুরিয়েছেন টাঙা গাড়ির চালক পণ্ডিত মণ্ডল। সারাদিন ঘুরিয়ে যখন আমাদেরকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে যান, সেই বিদায়ের মুহুর্তে আমাদেরকে অনতিদূরে থাকা চক মসজিদের গল্প বলেন। সেই মসজিদের সামনে যে বাজার ছিলো, সেখানে নাকি একসময় মেয়ে মানুষ বেচা-কেনা হতো।
পণ্ডিত মণ্ডল আরো কিছু গল্প আমাদেরকে বলেছিলেন চক মসজিদ সম্পর্কে। তার গল্প শুনে আমরা অস্থির হয়ে উঠি মসজিদটা দেখার জন্য। ঠিক হয়, সকালে প্রথম কাজ হবে আমাদের এই মসজিদ এবং তার সামনের বাজার ঘুরে দেখা।
সকাল ৯:০০টা। সুর্যটা বেশ তাপ ছড়াচ্ছে আজ। সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম “ঢাকাই হোটেল” থেকে। হোটেলটার নাম উল্লেখ করার কারণ, এই হোটেলের মালিকের পূর্ব পুরুষ একসময় ঢাকাতে থাকতেন। হোটেলটার খাবারে আমি কিছুটা বাংলাদেশী ফ্লেভারও পেয়েছি। যাহোক, খাওয়া শেষে এবারে আমাদের গন্তব্য চক মসজিদ।
গতকাল রাতে পণ্ডিত মণ্ডল চক মসজিদে যাওয়ার পথ বলে দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী হেঁটেই রওয়ানা দিলাম আমরা চারজন। চার থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে যেখানে পৌঁছালাম সেখানে সাদা গম্বুজবিশিষ্ট এক মসজিদ নজর কাড়লো আমার। এইটাই সেই চক মসজিদ। যেই মসজিদটাকে পণ্ডিত মণ্ডল বলেছিল, চাঁদনী চক মসজিদ।
চক মসজিদটার নির্মানশৈলী বেশ অন্যরকম। সাতটা গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের গম্বুজগুলো এমনভাবে সাজানো যা নজর কাড়বে যে কারোই। মসজিদের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমি ভিডিও রেকর্ড করতে থাকলাম। দেখলাম কিছু লোক কাজ করছে বাঁশ খুঁটি নিয়ে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সেখানে ইসলামী জলসা হবে। এই কথা শুনে অন্তত এটুকু নিশ্চিত হলাম, মুর্শিদাবাদের অন্যান্য পরিত্যাক্ত প্রাচীন মসজিদগুলোর মত নয় এই মসজিদ। এটা রীতিমত চলমান।
আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য আছে এই চক মসজিদকে নিয়ে। পণ্ডিত মণ্ডলই আমাদেরকে বলেছিলেন বিষয়টা। এই মসজিদের নির্মান করেছিলেন মীর জাফরের স্ত্রী মুন্নী বেগম। যিনি মীর জাফরের স্ত্রী হওয়ার আগে মুন্নী বাঈ নামে পরিচিত ছিলেন। এসম্পর্কে বিস্তারিত বলেছি আমার ভিডিওতে।
মসজিদের ভেতরকার কাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসি। দেখি সামনে কাঁচা সবজির বাজার নিয়ে বসে আছেন ২-৩ জন দোকানী। পণ্ডিত মণ্ডল বলেছিলেন, নবাবী পিরিয়ডে এইখানে বিক্রি হতো হিরা-জহরত। আর এখন পাওয়া যায় আলু, পটল, ঝিঙে। এছাড়া এই বাজারেই নাকি একসময় বিক্রি হতো সুন্দরী নারী। এখান থেকেই নাকি নবাব আলিবর্দি খাঁ তার নাতী নবাব সিরাজুদ্দৌলার জন্য লুতফুন্নেসাকে কিনে নিয়ে যান। এগুলো সবই ছিলো পণ্ডিত মণ্ডলের ভাষ্য।
ইতিহাস আর মিথ দুই-ই আছে এই চক মসজিদকে কেন্দ্র করে। আমার মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে দেখা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম এই মসজিদ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে কয়েকশ বছর পেছনে। আবার একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতিও পেয়েছি আমি। কেননা, যেই মীর জাফরের বংশধরদের খুঁজে বেড়িয়েছি আমি, এই মসজিদ যে সেই মীর জাফরের বেগমের হাতেই তৈরি!