সকাল সাতটা। মুর্শিদাবাদে এটা আমার প্রথম সকাল। গতরাতে ১০টার দিকে পৌঁছেছিলাম তৎকালীন সুবে বাংলার রাজধানী এই মুর্শিদাবাদে। নবাবী আমলের জৌলুস আর ঐতিহ্যমণ্ডিত বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে ছুটে এসেছি এই প্রাচীন নগরীতে। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করা হয় রাজধানী। তবে এই অঞ্চলে এখনো রয়ে গেছে নবাবী ভাব আর গাম্ভীর্য।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মীর জাফরকে নবাব হিসেবে অভিষেক ঘটায় ইংরেজরা। কারণ খুব স্পষ্ট। মীর জাফরের বেঈমানির কারণেই যে জয় পেয়েছিলো ব্রিটিশ কোম্পানি। সেই থেকে মীর জাফর নামটি বেঈমানির সমার্থক হিসেবে পরিগণিত হয়।
মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের সময় আমার ভেতরে বড় একটা প্রশ্ন ছিলো। এখন কেমন আছে সেই মীর জাফরের বংশধরেরা? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এমন সব তথ্য পেয়েছি, যা জেনে হতাশ হতে হয়েছে আমাকে।
ভোরের সিক্ত আবহাওয়ায় কিছুক্ষণ হেঁটেছি ভাগীরথী-হুগলী নদীর তীরে। স্থানীয়রা নাকি এই নদীকে গঙ্গা নদীও বলে থাকেন। চারিদিকে প্রাচীণ সব দালান-কোঠা আমাকে মুগ্ধ করতে থাকে। কিছুক্ষণ হেঁটে সকালের নাস্তা সেরে নিয়েছি। তারপর এগিয়ে গিয়েছি কেল্লা নিজামত এর দিকে। কেল্লা নিজামত এর প্রধান ফটকের কাছেই একটা চায়ের দোকান দেখে চা খেতে ঢুকে পড়লাম। দোকানী একজন পঞ্চাশোর্ধ নারী। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দোকানীকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। মীর জাফরের বংশধর যারা ছিলো, তারা কি এখনো আছে এ অঞ্চলে? দোকানী মহিলাটি মুখের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকালো। এরপর হাতের আঙুল দিয়ে ইশারা করে সামনে দেখিয়ে বললো, এই যে বাড়ি ঘর গুলো দেখা যাচ্ছে, তার সবই মীর জাফরের বংশধরদের। ঐ যে ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে, সেটাও এক মীর জাফরের বংশধরের। আশ্চর্য হয়ে সেদিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
চা শেষ করে বিল পরিশোধ করে দোকানীকে ধন্যবাদ দিয়ে ঢুকে পড়লাম কেল্লা নিজামতের মধ্যে। কেল্লা নিজামত এর ভেতরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে স্থাপনা, তার নাম হাজারদুয়ারী প্রাসাদ। প্রাথমিকভাবে আমার ধারণা ছিলো, এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদের নির্মাতা হয়ত সিরাজ-উদ-দৌলা কিংবা তার আগের বাংলার কোন নবাব। কিন্তু আমার ধারণার মুখে চপেটাঘাত করলো ইতিহাস। জানতে পারলাম, এই হাজারদুয়ারী প্রাসাদের নির্মাতা নাজিম হুমায়ুন জাহ। যিনি ছিলেন মীর জাফরের বংশধর। এই প্রাসাদের মধ্যেই সে সময় নাকি দরবার হল ছিলো। যেখানে বিচার কার্য সম্পন্ন করতেন ব্রিটিশদের তোষামোদকারী নবাবগণ। বর্তমানে এই ভবনটি মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার মধ্যে নবাবী আমলের অস্ত্র-শস্ত্রসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র রক্ষিত আছে।
কেল্লা নিজামত ঘুরতে ঘুরতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। দুপুরের খাওয়া শেষ করে মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যবাহী টাঙা গাড়িতে (ঘোড়ায় টানা বিশেষ বাহন) করে ঘুরে ইতিহাস স্বচক্ষে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের টাঙা গাড়ির চালকের নাম পণ্ডিত মণ্ডল। চলতে চলতে তার কাছ থেকে আরো জানতে পারলাম, মীর জাফরের বংশধরেরা বেশ আরাম আয়েশেই দিন কাটান এখনো। তাদের অনেকেই সরকারী বিভিন্ন উচ্চ পদে চাকুরীতে নিয়োজিত। প্রশাসনিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও তাদের পদচারণার কথা জানতে পারলাম পণ্ডিত মণ্ডলের কাছ থেকেই। টাঙা গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে গেলো মীর জাফরের বংশধরদের কবরস্থানে। সেখানে গিয়ে আমার চোখ তো কপালে ওঠার জোগাড়। মীর জাফরের বংশধরদের সেকাল থেকে একাল, সবার কবরই দেওয়া হয় এই নবাবী কবরস্থানে। আর সেই কবরস্থানের সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় চমৎকারভাবে।
পণ্ডিত মণ্ডল আমাদেরকে অনেক কিছুই ঘুরিয়ে দেখালো। ফেরার পথে দেখালো মীর জাফরের বাড়ি। যে বাড়ির মধ্যে বন্দি করে রাখা হয়েছিলো বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে। আর এ বাড়ি থেকেই তাকে হত্যা করা হয়েছিলো বলেও জানালো পণ্ডিত মণ্ডল।
সব দেখেশুনে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। হোটেলের সামনে পৌঁছে টাঙা গাড়িকে বিদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মনে তখন একটাই চিন্তা। মীর জাফরের বংশধর যে কেউ একজনের সাথে কথা বলবো। এমন সময় আমাদের হোটেলের স্টাফকে দেখতে পেয়ে তাকে বলে ফেললাম মনের কথা। সে আমাকে দেখিয়ে দিলো, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার ঠিক সামনে রাস্তার অপরদিকে একটি দোকান। জানালো, এই দোকানের মালিক মীর জাফরের বংশের লোক। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে। একজন মাঝবয়সী লোক বসা। তীক্ষ্ণ চোখ, ফর্সা চেহারা, মুখে সুন্দর কাটিং এর দাঁড়ি। আমার কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইলেন ভদ্রলোক। জবাবে আমি নিজের পরিচয় দেওয়া শুরু করলাম। তাকে জানালাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর। তাকে আমার ফেইসবুক পেজ (Explore With Manna) দেখালাম। তাকে বললাম, আমি জানতে পারলাম আপনি মীর জাফর আলী খানের বংশধর। আমি আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই এবং তার ভিডিও ধারণ করে রাখতে চাই। তিনি প্রথমে ইতস্তত করছিলেন। এক পর্যায়ে রাজি হলেন। আমাকে পরদিন সকাল ১০টায় সময় দিলেন। আমি খুশি মনে ফিরে গেলাম হোটেল রুমে।
পরদিন সকাল ১০টা বাজার আগেই হাজির হলাম তার কাছে। ওহ, লোকটার নাম বলতেই তো ভুলে গেছি। তার নাম সাইয়্যেদ গওহর আলম মীর্জা। ক্যামেরা রেডি করে প্রশ্ন শুরু করলাম আমি। সবচেয়ে আশ্চর্য হলাম, তিনি নিজের পরিচয় দিলেন, I am directly from Mir Jafar Ali Khan। যে মীর জাফরকে আমরা ঘৃণাভরে স্মরণ করি, এই লোকটা তার বংশধর বলে গর্ববোধ করলেন। তার সাথে দীর্ঘ আলাপের পর ফিরে আসলাম হোটেল রুমে।
এই হোটেল ছেড়ে দিতে হবে এখন। যেতে হবে অন্যত্র। হোটেলে চেকআউট করার সময় বুঝলাম অবাক হওয়ার অনেক কিছুই বাকি ছিলো আমার। হোটেল ম্যানেজারের কাছে রুমের চাবি ফেরত দেওয়ার সময় তিনি আমাদেরকে জানালেন, যেই হোটেলে রাত্রি যাপন করেছি আমরা, সেই হোটেলের মালিক নিজেও মীর জাফরের বংশধর। গতরাতে সেই ব্যক্তি নিজেই আমাদেরকে রুমগুলো দেখিয়েছিলেন।
মীর জাফরের বংশধরদের এলাকা ছেড়ে যাচ্ছি। গাড়ির মধ্যে বসে ইতিহাস আর বর্তমানের খেলা নিয়ে ভাবনায় ডুবে গেছি। কেউ বেঈমানি করলেই যে আমরা তাকে মীর জাফর বলে বসি। হঠাৎ এই সময়ে এসে মনে প্রশ্ন তৈরি হলো মীর জাফরের জন্য বেঈমানি নাকি বেঈমানির জন্য মীর জাফর?