দেবতাখুম ভ্রমণ

দেবতাখুম ভ্রমণ এবং এক অজানা ঝর্ণায় এডভেঞ্চার

দেবতাখুম। বান্দরবানের গহীনে এক এডভেঞ্চারাস ফিলিং। যেখানে সুর্যের আলো লুকিয়ে যায় পাথুরে দেয়ালের আড়ালে। শোনা যায় নীরবতার মোহনীয় এক সুর। বোঝা যায় প্রকৃতির রোমাঞ্চকর ভাষা।

আমার এবারের গন্তব্য এই দেবতাখুম। যেখানে দেখেছি এক অন্যরকম সৌন্দর্য। সেই সাথে দেখেছি শীলবান্ধা ঝর্ণা। আর একই সাথে এমন একটা ঝর্ণা এক্সপ্লোর করবো আজ প্রথমবারের মত, যেখানে এর আগে যায়নি কেউ কোনদিন।

বান্দরবানের পথে

দেবতাখুম যেতে সবার আগে দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে আসতে হবে বান্দরবান। ঢাকা থেকে হানিফ, শ্যামলী, সৌদিয়াসহ বিভিন্ন পরিবহনের একাধিক গাড়ি যাতায়াত করে এই রুটে। ভাড়া ৯০০ টাকার মত পড়বে জনপ্রতি।

বান্দরবান টার্মিনাল থেকে ইজিবাইক নিয়ে রাজার মাঠ। ভাড়া ২০ টাকা। রাজার মাঠ থেকে রোয়াংছড়ি যেতে সিএনজিতে জনপ্রতি ১০০ টাকা। রোয়াংছড়ি থেকে কচ্ছপতলীর সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা।

কচ্ছপতলীতে রাত্রিযাপন

আমরা পৌঁছে গেলাম ট্র্যাডিশনাল হোটেলের বাঁশের তৈরি কটেজে। এই হোটেলে দুই ধরনের রুম – ভিআইপি (৩-৪ জন, ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা) এবং বাঁশের কটেজ (৮-১৬ জন, ভাড়া ২৫০০-৩৫০০ টাকা)। আমরা নিলাম বাঁশের কটেজ। কটেজ থেকে থারাংছা নদীর চমৎকার ভিউ দেখা যায়।

রাতের খাবার: ব্যাম্বু চিকেনের জাদু

ডিনারের জন্য আমরা অর্ডার করেছিলাম সাদা ভাত, সবজি, আর পাহাড়ের স্পেশাল ব্যাম্বু চিকেন। সেই সাথে ভর্তা আর ডাল তো থাকছেই। সকল আইটেম গুলোর স্বাদ এভারেজ লাগলেও, ব্যাম্বু চিকেন এর স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। আমি মুরগির মাংস জীবনে অনেক যায়গায় খেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করেন, এই রকম স্বাদ আমি জীবনে কোথাও পাইনি। দেবতাখুম ভ্রমণে আসলে এইখানে ব্যাম্বু চিকেনের স্বাদটা নিয়ে যাবেন। এটা আমার রিকমেন্ডেশন বলতে পারেন।

শুভ সকাল কচ্ছপতলী

সকালে ফ্রেশ হয়ে আলু ভর্তা ও ডাল দিয়ে নাস্তা করে যাত্রা শুরু। জয়দা এবার আমাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন পুলিশ বক্সের দিকে। সেখানে আমাদের নাম ঠিকানা সম্বলিত ফর্ম আর জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়া হলো। এরপর পুলিশ আমার কাছে আমার এবং আমার সাথের ২ জনের পরিচয় জানতে চাইল। পরিচয় দেওয়ার পর অনুমতি দিয়ে স্বাক্ষর করলো পুলিশ।

পুলিশ বক্স থেকে বেরিয়ে জয়দা সহ আমরা চারজন একসাথে রওয়ানা দিলাম সামনের দিকে। সামনেই আর্মি চেকপোস্ট। সেখানে আবারো জমা দিতে হলো জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি। সকল ফর্মালিটিজ শেষ। এবারে সামনে একটাই লক্ষ্য দেবতাখুম।

দেবতাখুমের পথে

কচ্ছপতলী থেকে দেবতাখুমের দিকে যাওয়ার দুইটা ওয়ে আছে। চাইলে সিএনজি বা চান্দের গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়, ভাড়া পড়বে ৫০ টাকা জন প্রতি। আবার আমার মত বৃষ্টির দিনে গেলে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করেও যাওয়া যায়। ইঞ্জিন চালিত এই নৌকা তথা ট্রলারে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়া। তবে আমরা রিজার্ভ করে নিয়ে গিয়েছিলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। 

পাথুরে নদীর বুক চিরে বোটে করে চলা কিন্তু খুব একটা সহজ নয়। পাথরে ধাক্কা লেগে একটা বিপদ ঘটতে কিন্তু এক মুহূর্ত লাগে। তবে বোট চালকরা বেশ পটু থাকায় উপভোগ করতে লাগলাম পুরো বোট জার্নি। মাঝে মধ্যে পাহাড়ি জংগলের ভেতর দিয়ে যখন ট্রলার চলছে, তখন কেমন যেন মনে হচ্ছে সুন্দরবনের ভেতরে কোন খাল পাড়ি দিচ্ছি। প্রায় আধা ঘণ্টা মত ট্রলারে চলার পর পৌছালাম শীলবান্ধা পাড়া ঘাটে।

শীলবান্ধা পাড়া পেরিয়ে পৌঁছেছি টিকেট কাউন্টারে। ১৫০ টাকার টিকেটের দাম বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। এই টাকায় আমরা পাবো একাধিক বোট আর লাইফ জ্যাকেট। একাধিক বোট বললাম তার কারণ হলো দেবতাখুমের মূল পয়েন্টে যাওয়ার আগে আমাদের একাধিক বোটে চড়তে হবে। মাঝে মধ্যে বিপজ্জনক কিছু পাহাড়ি পাথুরে স্লিপারী পথে হাটতে হবে। শীতকালে এতটা পথ হেঁটেই যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা বর্ষাকালে গিয়েছি বিধায় আমাদের হবে কিছু রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।

প্রথম বোটে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে পা পিছলে পড়লাম আমি। বেশ ভাল রকম কাদার ছাপ লেগে গেলো আমার পেছনে। তবে শুধু আমি একা নই। আমার পর একইভাবে পড়েছেন আরো কয়েকজন। 

কিছুটা বোট কিছুটা স্লিপারী পাথরে ট্রেকিং, এভাবে চলতে থাকলাম আমরা। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেলাম মূল ঘাটে। যেখান থেকে পাওয়া যায় ভেলা কিংবা নৌকা। এইবারে একটা গুরুত্বপূর্ন তথ্য দেই। যেহেতু বর্ষাকাল, খুমের পানি অনেক বেশি, সেই সাথে তীব্র স্রোত – কাজেই ভেলা একেবারেই বন্ধ। খুমের ভেতর ঢোকার একমাত্র উপায় বোট।

খুমের অভিজ্ঞতা

এইখান থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত বোটটাতে উঠে পড়েছি আমরা। স্রোতের বিপরীতে আমাদের এগিয়ে চলা। বোটে ওঠার আগেই জয় দা আমাদের লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিলেন। এগিয়ে চলেছি আমরা নীরবতার দিকে। 

ধীরে ধীরে আমরা ঢুকে পড়ছি খুমের ভেতর। যত ভেতরে যাচ্ছি, শরীর মন দুটি শীতল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। বাইরে যখন ছিলাম, তখন বেশ গরম। কিন্তু খুমের ভেতর খুবই ঠাণ্ডা। 

দেবতাখুমের ব্যাপারে যেই তথ্যটা জানলাম আমরা, তাহলো – ২০১৯-২০ সালের দিকে প্রথম এইখানে মানুষজন আসা শুরু করে। তার আগে এই যায়গাটা পুরোটাই ফাকা ছিলো এক প্রকার। পরে মানুষজন যখন বেশি বেশি আসতে শুরু করে, তখন স্থানীয়রা এই যায়গাটাকে নিজেদের মত করে সংরক্ষণ করা শুরু করে। দেবতাখুমের একটা পাথর আছে যেটাকে মার্মা আদিবাসীরা পূজা করে এই উদ্দেশ্যে যে, যে সকল পর্যটকরা ঘুরতে আসেন তাদের যেন কোন ক্ষতি না হয়। 

দেবতাখুমের নামকরন নিয়েও আমাদের জানালেন আমাদের বোটের মাঝি। আমরা খুমের যেই মেইন পয়েন্টটাতে পৌঁছেছিলাম, সেইটা ছিলো খুমের সবচেয়ে গভীরতম স্থান। সেখানে নাকি গভীরতা ৭০-৮০ ফিট। পানির গভীরতা যেখানে বেশি, সেই জায়গাকে সাধারণত খুম বলা হয়ে থাকে। আর উপড়ে যে পাথরের পূজা করার ব্যাপারটা উল্লেখ করলাম, সেখান থেকেই দেবতাখুমের নামকরণ।

অজানা ঝর্ণার সন্ধানে

দেবতাখুম ঘুরে বেরিয়ে আসলাম আমরা। পানি আর স্রোত দুটোই অনেক বেশি থাকায় ভেতরের অনেক এক্টিভিটি করতে পারিনি আমরা। সে যাইহোক এমন সুন্দর একটা অনুভূতি নিয়ে এবারে যাবো এমন একটা ঝর্ণা এক্সপ্লোর করতে যেখানে নাকি আগে যায়নি কেউ কোনদিন। আমাদের গাইড জয় দা অন্তত তেমনটাই জানিয়েছেন আমাদের। 

আবার চলে আসলাম দেবতাখুমের সেই টিকেট কাউন্টারে। বাই দ্যা ওয়ে, আমি বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি এখন আছি সম্পুর্ন নেটওয়ার্ক এর বাইরে। টিকেট কাউন্টারের পাশে এইখানে একটা দোকান আছে। সেখানে একটা ল্যান্ড ফোন স্টাইলের ফোন আছে। এই গোটা অঞ্চলে নাকি শুধু এই ফোনটাতেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাও আবার এই সিঁড়ির উপর উঠলে নেটওয়ার্ক আসে এই ফোনে। প্রতি কল ২০ টাকা। আমি নিজেও একটু কথা বলে নিলাম সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে। 

দেবতাখুমের টিকেট কাউন্টার এলাকা থেকে এবারে রওয়ানা দিয়েছি সেই অপরিচিত ঝর্ণাটা দেখার জন্য। আমাদেরকে স্থানীয় কেউ কেউ বলেছেন ১৫-২০ মিনিটের পথ। এত অল্প সময়ের পথ বলা হলেও আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা এই ভয়ংকর পথে হেঁটে ফেলেছি। এবারে সামনেই উন্মোচিত হয়েছে সেই ঝর্ণা, যেটা আজ প্রথমবারের কোন পর্যটক হিসেবে এক্সপ্লোর করছি আমরা।

শীলবান্ধা ঝর্ণা

ঝর্ণার শীতল পানিতে ভিজে ফিরতে শুরু করেছি। এবারে আমাদের গন্তব্য শীলবান্ধা ঝর্ণা। এইটা এতটা এক্সট্রিম লেভেলের না। দেবতাখুম আসলে মোটামুটি সবাই এই ঝর্নাটাতে গা ভেজান। শীলবান্ধা পাড়া থেকে নদী পার হতে হবে এবারে। নদীটা পার হতে পারলেই মাত্র ২-৩ মিনিট ট্রেকিং করে পৌঁছা যাবে শীলবান্ধা ঝর্নায়। 

প্রায় আধাঘণ্টা ঝর্ণায় ভিজে শরীর শীতল করে নিয়েছি আমরা সবাই। ঝর্ণায় ভেজার সময় ঝর্ণার পানির মধ্যে রংধনু টাইপ জিনিস আমার হৃদয়ের দুয়ারে কড়া নেড়েছে বার বার। যেন বলেছে, তুমি ঘোষণা করো – স্রষ্টা কতটা মহান। 

ফেরার পথে

শুরুতে বলেছিলাম আমরা ট্রলারে করে যাত্রা শুরু করলেও চেষ্টা করবো বাই রোডে ফিরতে। সে হিসেবেই শুরু হলো ট্রেকিং। এইবারে উপরে উঠতেই আছি। পাহাড়ের আপহিল রোড যেন আর শেষ হয় না। অনেক খানি ট্রেকিং করার পর পেয়ে গেলাম একটা চান্দের গাড়ি। রওয়ানা দিলাম কচ্ছপতলীতে আমাদের হোটেলের উদ্দেশ্যে। সেখানেই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে।

দেবতাখুম আমার মনে এক শান্তির অনুভূতি দিয়ে গেল। এমন ভ্রমণ সত্যিই বারবার করতে মন চায়। এই অজানাকে জানা আমার ভ্রমণ পিপাসা যেন বাড়িয়ে দিয়েছে আরো বহুগুণ।

বাজেট হিসাব (জনপ্রতি):

  • – ঢাকা-বান্দরবান বাস: ৳৯০০ (one way)
  • – বান্দরবান-রাজার মাঠ ইজিবাইক: ৳২০
  • – রাজার মাঠ-রোয়াংছড়ি সিএনজি: ৳১০০
  • – রোয়াংছড়ি-কচ্ছপতলী সিএনজি: ৳৭০
  • – কটেজ রুম শেয়ার করে: ~৳৩৫০
  • – রাতের খাবার + সকালের নাস্তা: ৳৩০০
  • – গাইড ফি: ৳৩৩৩ (৳১০০০ ÷ ৩ জন)
  • – ট্রলার রিজার্ভ: ~৳২৩৩ (৳৭০০ ÷ ৩ জন)
  • – দেবতাখুম টিকিট: ৳২০০
  • – আনুমানিক অতিরিক্ত খরচ (নাস্তা, চান্দের গাড়ি, কল): ৳৩৫০

**মোট আনুমানিক খরচ: ৳২৮৫০-৩০০০ টাকা (প্রতি জন)**

আমার আগের ব্লগ মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতিতে এক রাত মিরিঞ্জা ডেঞ্জার হিলে পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

দেবতাখুম ভ্রমণ

Related Post

Explore Videos